মাঝে সাঝেই আমরা বিরক্ত হয়ে বলি, বেশি লেকচার দিস না বা এই রে শুরু হলো বক্তৃতা। কিন্তু এই বক্তৃতা বা লেকচার দেওয়াটা যে কতটা কঠিন বা ভয়ংকর হতে পারে, তা মনে হয় প্রেজেন্টেশন বা স্পিচ দিতে গিয়ে হাঁটু কাঁপাকাপির সেই দুঃসহ অনুভুতিময় স্মৃতিতে অনেকেরই জানা আছে।
অনেকেই
হয়তো জানে না,বক্তৃতা দিতে আসলে কম বেশি সবাইই ভয় পায়, এই ভয় এর শিকার
শুধু আমি বা আপনি একা নন। তবুও জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিশেষ করে স্কুল,
কলেজ, ইউনিভার্সিটি বা অফিস আদালতে এই ভয়ংকর কাজটি প্রায়ই করতে হয়
আমাদেরকে। কাজেই ভয়ংকর কাজটির এই ভয়ংকর ভয় কাটাতে আমাদেরকে প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে যে “ভয়” আসলেই কি ?
ভয়টা আসলে বিপদের আশংকাই তো, তাইনা? কিন্তু এই বক্তৃতা বা স্পিচ বা
প্রেজেনটেশনে আবার ভয় কিসের! এই ভয়টা কি আসলেই একটা ভয় নাকি আমাদেরই সৃষ্ট
কল্পিত ভয়? হুম, একটু ভাবলেই ধরে ফেলা যায় যে এ ভয়টা সম্পুর্ণ কল্পিত একটা ভয়।
কাজেই এই ভয় কিভাবে কাটানো যায়? সেটা নিয়েই আমার এই লেখাটা। তার
আগে এই টপিকটা মাথায় কেনো আসলো সেটা বলি। কিছুদিন মানে বেশ কিছুদিন আগে
১৫ই মার্চ গিয়েছিলাম এক মজাদার সেমিনারে। সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিলো স্পিচ
বা বক্তৃতা বা লেকচার বা প্রেজেন্টেশন। সেখানে গিয়েই এই জীবনে আমি প্রথম
জানলাম ওয়ার্ল্ড স্পিচ ডে বলেও একটা নাকি দিন দুনিয়ায় আছে আর সেটা নাকি
সেদিন! যাক বাবা তার মানে এই স্পিচ দিতে গিয়ে যত না ভয় পেতাম আমি তা নিয়ে
সারা বিশ্বের মানুষও আসলে ভাবে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই ভয়ংকর বিষয়টা
নিয়ে সেমিনার যত এগুতে থাকলো আমার চোখের সামনের কালো পর্দাটাও তত সরতে
থাকলো আমি বুঝলাম আমি কেনো এত ভয় পেতাম প্রেজেন্টেশন বা স্পিচকে। আর এই
স্পিচ বা প্রেজেন্টেশন যে আমাদের জীবনে কতবারই দরকারে আসে বার বার আর তাই
সেটা কিভাবে সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় সেটা শেখাটাও অতীব জরুরী।
তো সেদিন, যা শুনলাম, দেখলাম ও জানলাম----
প্রেজেন্টেশন বা স্পীচ দেবার ভীতি কাটাতে প্রথমেই যেটা করতে হবে, ভয়ের মুখোমুখি হতে হবেঃ-
ভয়ের
মুখোমুখি হওয়া মানে ভয়ের উৎস খুঁজে বের করা। আসলে মানুষ যে কারণে সবার
সামনে কথা বলতে ভয় পায় তা হলো অনিশ্চয়তা। এককথায় বলতে গেলে আমরা জানি না
বক্তৃতা বা প্রেজেন্টেশনের সময় কি ঘটবে। ভয়ের কারণটা নিশ্চয়ই এমন নয় যে
আমাদেরকে এমন একটা বিষয়ে বলতে হবে বা প্রেজেন্ট করতে হবে যে সে বিষয়
সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। কিছুই না জেনে মানুষ তো আর কিছু বলতে উঠে না
তবে তারপরেও বক্তার অনিশ্চয়তায় ভোগার মত অনেক কারণ থাকতে পারে যেমন সবাই
বক্তার আইডিয়া কিভাবে গ্রহণ করবে ? তার বক্তব্য কিভাবে মুল্যায়িত হবে অথবা
শ্রোতা কতটুকু প্রভাবিত হবে? যদি ভুল বলে ফেলি? যদি কেউ কথা শুনে হাসতে
শুরু করে? এমন শত শত। তবে যদি শুরুটা বেশ ভালো ভাবে করা যায় এবং বিষয়টার
উপর স্বচ্ছ ধারনা দেওয়া যায়, তবে শ্রোতা যেমন আনন্দিত হবে আর বক্তার ভয়ও
অনেকাংশেই দূর হয়ে যাবে।
কাজেই
ভয়কে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। যদি ভয়ে হাঁটু কাঁপতে থাকে তবে স্মরণ
করতে হবে সেই অব্যার্থ মন্ত্র, ভয়টা আসলে মিথ্যা , প্রমাণটাই হলো আসল। যে
কারণে ভয় পাচ্ছি তা আদৌ ঘটবে না। যদি কোনো গরমিল এর ব্যাপারে আগে থেকেই
চিন্তিত থাকি, যদি তেমন কিছু ঘটেও যায় তবে তা সাথে সাথে শুধরে নেওয়া যাবে।
ভয়ের কারণেই গরমিল হয়। ভয় না পেলে গরমিল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিজের মনোবল
বাড়িয়ে ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ভয় না পাওয়াটা প্রথম শর্ত এবং এর পরের শর্ত প্রস্তুতিঃ-
ভালোভাবে
প্রস্তুতি নেওয়াটা বিশেষ জরুরী। তাই প্রথমেই যে যে বিষয়ে বলতে হবে তার
পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি বিশেষ প্রয়োজন। এরপর বক্তব্যের বর্ণনা, এবং তারপর
মূল পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করতে হবে। প্রথমে কি বলবো মানে বক্তব্যের
ইন্ট্রোডাকশন, বক্তৃতার মাঝখানে কি বলবো মানে মেইন বডি বা মূল বক্তব্য,
এরপর শেষটাই বা কিভাবে করবো মানে কনক্লুশন তা ঠিক করে নিতে হবে। এ ছাড়া
পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড, স্ক্রিপ্ট এসব থাকলেও রেডি করে ফেলতে হবে।
তৃতীয় শর্ত চর্চাঃ-
ইংরেজীতে
একটা কথা আছে “Practice makes a man perfect ”. তাই পৃথিবীতে যাই করি না
কেনো প্রাকটিস বা চর্চা করলে হবে না এমন কিছুই নেই। আর এই কথা বলার জড়তা বা
ভীতি যেটাই হোক না কেনো দূর করতে হলেও চর্চার বিকল্প নেই। স্পিচ
প্রাকটিসের সবচেয়ে ইউজফুল চর্চাটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা প্রাকটিস ।
এই চর্চায় আত্মবিশ্বাস বাড়ে, একদম হাড়ে হাড়ে প্রমানিত। রেকর্ড বা ভিডিও
করেও প্রাকটিসের ভুল ত্রুটি নিজে ধরা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন ল্যাংগুয়েজ
ক্লাব, ডিবেটিং সোসাইটিতে সাময়িক বা পুরোপুরি অংশ নেওয়া যায়।
শেষ শর্ত বা ধাপ মনোবলঃ-
মনোবল
নিয়ে শ্রোতার সামনে দাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, আমি যখন কারো
সামনে মাইকে কিছু বলি আমার চেহারা দেখে কেউ বুঝতে পারেনা ভেতরে কি হচ্ছে
মানে খুব স্বাভাবিকই লাগে নাকি কিন্তু আমি জানি আমার বুকের মধ্যে কত শত ঝড়
ঝঞ্জা, টর্নেডো, সিডর কি না বয়ে যায়। তবুও আমি হাসি হাসি মুখে অভিনয় করি,
আমি একটুও ভয় পাচ্ছিনা এমন ভাব।
এ কথা বলার উদ্দেশ্য আসলে শ্রোতা
আমাদেরকে দেখতে পায়, আমাদের স্নায়ুচাপ তো দেখতে পায় না। কাজেই একটু
স্নায়ুচাপ কাজ করলেও সফলভাবে বক্তৃতা শেষ করা সম্ভব । কাজেই মনোবল বাড়াতে
হবে, স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বক্তব্য দিতে হবে।
শ্রোতার
ব্যপারে বেশি মাথা ঘামাবার দরকার নেই। বক্তৃতার সময় একেক জনের প্রতিক্রিয়া
একেক রকম হবে এটাই স্বাভাবিক । বক্তৃতা বা প্রেজেন্টেশনের সময় শ্রোতার সাথে
চক্ষু-সংযোগ বা আই কনট্যাক্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে ,
মাথা নিচু করে বা অন্য কোনোদিকে তাকিয়ে কথা বলা যাবেনা, শ্রোতার চোখের দিকে
তাকাতে ভয় পেলেও চলবেনা।
সবশেষে
একটা কথাই মনে রাখতে হবে, বক্তৃতা, প্রেজেন্টেশন সবার সামনে নিজের
চিন্তা-চেতনা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার সুযোগ দেয়। এটা মানুষকে সামনে এগিয়ে
যেতে সাহায্য করে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে সাহসী করে তোলে। আর
একটু ভেবে দেখলে দেখা যায় নিজের বন্ধু, সহকর্মী ,সমমনাদের সামনে কিছু বলতে
আসলেই ভয়ের কিছু নেই। কাজেই নো চিন্তা । সকল দ্বিধা দ্বন্দ ভয় ভীতি ঝেড়ে
ফেলে আত্নবিশ্বাসে সাথে বক্তৃতা, স্পিচ বা প্রেজেন্টেশনে নো চিন্তা এনি
মোর।
আরও কিছু জিনিস ভাবার আছে মানে শেষ হইয়াও হইলো না শেষঃ-
১)কোথায়
কথা বলতে হবে সেটি মাথায় রাখতে হবে। কারণ একেক পরিবেশে একেক রকমভাবে
বক্তব্য উপস্থাপন করতে হয়। কোন কনফারেন্সে যেভাবে কথা বলতে হয়, পাবলিক
স্থানে নিশ্চয় সেভাবে কথা বলা যায় না।
২) বক্তৃতা বা স্পীচ
মাইক্রোফোন ব্যবহার করে দেওয়া হবে নাকি মাইক্রোফোন ছাড়াই কথা বলতে হবে, সে
সম্পর্কে আগে থেকে জানতে হবে? স্টেজের কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে সেটা
জানাও জরুরী।
৩)দর্শক-শ্রোতাদের
সম্পর্কে জানাটা জরুরী। তারা শিশু নাকি ছাত্র নাকি বয়স্ক নাকি মধ্যবয়স্ক
সে সম্পর্কে আগে থেকেই জানতে হবে। তাদের প্রফেশন, মেন্টালিটি এসব বিষয়ে
একটু ধারনা করে নিতে হবে।
৪)যতদূর সম্ভব বক্তব্যের বিষয়ে জানা।কোন
বিষয়ে ভালো না জেনে কথা বলা উচিত নয়। অডিয়েন্সের মধ্যে এমন কেউ থাকতে
পারে যিনি ওই বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন। তাই আগে থেকেই সাবধান হওয়া উচিত।
৫)
বক্তৃতার বিষয় মনে রাখার সুবিধার জন্য কোন কাগজে বা ব্যানারে লিখে রাখা
যেতে পারে যেমন, কোন আলোচনা সভা হলে ব্যানারে সভার বিষয়বস্তু, আয়োজকের
নাম বা কোম্পানির পণ্য,ব্র্যান্ড পরিচিতি অনুষ্ঠানে স্লাইডে কোম্পানির নাম,
ওয়েবসাইট, পণ্যের মটো ইত্যাদি লিখে রাখা যেতে পারে।
৬) কন্ঠস্বর
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কণ্ঠস্বর যেনো স্বাভাবিক থাকে সেদিকে লক্ষ্
রাখতে হবে। গলাফাটা চিৎকারও নয়, আবার নিচুস্বরও নয়, এমন টোনে কথা বলতে
হবে। সাহিত্য সভায় ভয়েস ন্যাচারাল থাকলেও চলবে, কিন্তু প্রতিবাদসভায়
ভয়েস হতে হবে জোরালো।
স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত ছাড়াও যারা
শিল্পসাহিত্য, আবৃত্তি, সঙ্গীত, অভিনয়, রাজনীতি বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত
তাদের জন্যও বক্তৃতা, প্রেজেন্টেশন বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে পূর্বপ্রস্তুতি
নেয়া ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তাই আরও কিছু ব্যাপারে সতর্কতা প্রয়োজন।
যেমন-
১. ড্রেস আপ, গেট আপ ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজঃ পোষাক ও
অন্যান্য কিছু বিষয়ের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হতে হবে। ইস্ত্রি করা পরিছন্ন
পোষাক এবং দৃষ্টিকটু ক্যাটকেটে রঙ পরিহার করা উচিৎ। হাঁটাচলা, হাত নাড়ানো,
কথা বলা সবকিছুতে স্বাচ্ছন্দ্য আছে কি না খেয়াল রাখতে হবে। গলা শুকিয়ে
যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে পানি খেয়ে নেওয়া যেতে পারে। এলো মেলো উস্কুখুস্কো
চুল দাঁড়ির বদলে পরিছ্ন্ন ঝা চকচকে মুখের স্মার্ট প্রেজেন্টেশন বেশি
উপভোগ্য।
২. ক্লিয়ার কন্সেপ্ট ও টাইম ম্যানাজমেন্টঃ যে
বিষয়ে উপস্থাপনা করতে হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে। সময়
সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে অর্থাৎ কতটুকু সময় ধরে কথা বলা দরকার তা ঠিক করে
রাখতে হবে। এই উপস্থাপনার মাধ্যমে কি একটি অথবা তারও বেশি বার্তা পৌঁছুতে
আগ্রহী সে ব্যাপারে আগে থেকেই ধারণা রাখতে হবে?
৩.দর্শক শ্রোতা সম্পর্কে আগাম ধারণাঃ-
কারা এই অনুষ্ঠানের দর্শক শ্রোতা হয়ে এসেছেন? কী জন্য এবং কিসের আগ্রহে
তাঁরা এসেছেন? সংখ্যায় তাঁরা কত হতে পারে? সেস জেনে নেওয়া ভালো। ভাষা ও
সহজ বোধ্যতার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।
৪. উপকরনগুলি সম্পর্কে জেনে রাখাঃ- দর্শক-শ্রোতাদের
প্রতি বক্তব্য সঠিকভাবে পৌঁছুনোর সুব্যবস্থা আছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে
হবে ? বিদ্যুৎ ও আনুষঙ্গিক সহযোগগুলো ঠিকঠাক আছে কি না? উপস্থাপনার জন্য
প্রয়োজনীয় অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমগুলো সচল বা কার্যকর আছে কি?
৫. সামঞ্জস্যতাঃ-
অনুষ্ঠানের সাথে উপস্থাপনার বিষয়টি মানানসই আছে কি না এবং কিভাবে তা ভেবে
দেখা দরকার। দর্শক-শ্রোতা যাতে ক্লান্তি বোধ না করেন তা দৃষ্টিতে রাখা।
যদি তেমন হয়ে থাকে তাহলে তাঁদের উজ্জীবিত করার জন্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিলে
যায় এমন বিকল্প উপস্থাপনার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। সব শ্রোতার মনযোগ
কখনই একসাথে ধরে রাখা সম্ভব না। তবে অধিকাংশ শ্রোতার মনযোগ ধরে রাখতে হলে
একখানে দাড়িয়ে না থেকে হেঁটে হেঁটে কথা বলতে হবে, আকর্ষনীয় কথা হতে হবে এবং
শ্রোতাদেরকে সম্পৃক্ত করে কথা বলতে হবে।
মূলত যিনি উপস্থাপনা
করবেন তাকে সবদিক থেকে চিন্তা করে সাবলীল হতে হবে। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস
আনতে হবে। মঞ্চে এমনভাবে দাঁড়ানো যাবে না যাতে দেখতে বোকা বোকা লাগে আবার
খুব বেশি অহংকারী মনে হয় এমন ভাবও পরিহার করতে হবে। সাধারণত উপস্থাপনারে
ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় যে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ শোনা
যাচ্ছে, নিজেকে বোকা দেখাচ্ছে বলে ধারনা হতে থাকে, অহেতুক তাড়াহুড়োভাব
এবং ভুল হয়ে যায়। সর্বোপরি দর্শক শ্রোতা বিরক্তবোধ করছেন বলে মনে হতে
থাকে। সঠিক ভাবে উচ্চারণও বিশেষ প্রয়োজনীয়। কথা গুলো এমন হওয়া উচিৎ হবে যা
সবাই পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারে। উপস্থাপনা করার সময় কথা গুলো খুব দ্রুত বা
হুড়মুড় করে না বলাই ভালো, সময় নিয়ে বুঝিয়ে ও পরিষ্কারভাবে কথা বললে সবার
বুঝতে সুবিধা হবে এবং সবার মনযোগ বজায় থাকবে। সোজা ভাষায়-
যা করতে হবে:১.
মঞ্চে উঠে সবচেয়ে আগেই দর্শকশ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে খুব
আন্তরিকতার সঙ্গে প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুটো কথা বললে ভয়টা
অনেকাংশেই কেটে যায়।
২. যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী এবং ইতিবাচক মনোভঙ্গীর প্রকাশ করতে হবে।
৩. শুরু করার আগেই মনে মনে একটি ধারানুক্রম সাজিয়ে নিতে হবে, কী কী বিষয় এবং কখন কখন বলতে হবে মনে মনে তার ধারণা রাখতে হবে।
৪. মূল অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ সময়ের কতটুকু অংশে নিজের উপস্থাপনার জন্য তা পরিমাপ করতে হবে।
যা কখনও করা যাবেই না:
১. নিজের দুর্বলতা বা সবলতা সম্পর্কে বলার কোনোই দরকার নেই।
২. এলোমেলো এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলা যাবে না।
৩. দর্শক-শ্রোতাদের প্রতি কোনো অভিযোগ করা যাবে না।
৪. সমাজে বলা অসঙ্গত এমন কৌতুক বা উপকরণ পরিবেশন করা যাবে না।
৫.এমন ভাব নেওয়া যাবেনা যে মনে বক্তা দুনিয়ার সবকিছু জানে। ( হামবড়া বা সর্বজান্তা ভাব আর কি)
৭. দর্শক ও শ্রোতাদের প্রতি কোনো বিব্রতকর ও বিরক্তিকর প্রশ্ন বা উক্তি ছুঁড়ে দেওয়া যাবেনা।
উপস্থাপনা
এবং বক্তৃতা এমন একটা মাধ্যম যা আমাদেরকে অন্যদের সামনে আমাদের যোগ্যতা ও
সৃষ্টিশীলতার পরিচয় প্রকাশ করে। কেউ যদি হতে চায় শিক্ষক, কর্মক্ষেত্রের
অফিসার এবং নেতৃস্থানীয় কোন ব্যক্তিত্ব তবে এই স্পীচ ও উপস্থাপনার কলা কৌশল
শেখা খুব জরুরী। কেঊ কেউ ভাবে আমার দ্বারা এটি হবে না মানে একেবারেই
অসম্ভব কিন্তু এটা ভুল। শুধু একটু সতর্ক প্রস্তুতি ও কিছু কলা কৌশল অবলম্বন
করলে যে-কেউ একজন সফল ও জনপ্রিয় উপস্থাপক হতে পারে।
এই
ছিলো আমার স্পীচ বা বক্তৃতা বা প্রেজেন্টেশেনের জানা কলা কৌশল বা ছলা কলা
তবে আমাদের সেদিনের সেই সেমিনারে একজনকে দেখে ও তার কথা শুনে তো আমি মহা
মুগ্ধ! তিনি এক মনোমুগ্ধকর বক্তা! সেদিনের অনেক সফল বক্তাদের সাথে তিনিও
শুনিয়েছিলেন স্পীচ বা প্রেজেন্টেশনে তার সফলতার কাহিনীগুলি। নীচে আমি সেই
সফল কমেডিয়ান কাম বক্তা কাম উপস্থাপকের কথাই লিখছি।
নাভিদ মাহবুবঃ-
পেশায়
তিনি ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু সকলেই তাকে চেনেন কমেডিয়ান হিসাবে। কিভাবে তিনি
হলেন ইঞ্জিনিয়ার থেকে কমেডিয়ান! সেও এক মজার কাহিনী। এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা
বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৩তম, এইচএসসিতে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন
নাভিদ মাহবুব। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায়
হয়েছেন দ্বিতীয়। সেখান থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক।
উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৯২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। স্নাতকোত্তর মিশিগান
বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সারাজীবন এত ভালো ফলাফল করা নাভিদ মাহবুব যখন তার
বক্তব্য প্রেজেন্ট করতে গেলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনই ঘটলো বিপত্তি। এরপর
তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক হয়ে ওঠেন ও কিছু বক্তৃতা কর্মশালা বা ক্লাবেও
প্রশিক্ষন নেন।
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসে স্ট্যান্ড আপ
কমেডি প্রতিযোগিতা কমেডি ফেস্টিভালে ১৫০ প্রতিযোগীদের মাঝে সবাইকে চমকে
দিয়ে ১৪৯ জন আমেরিকানকে পেছনে ফেলে 'সেরা পুরুষ কমেডিয়ান' নির্বাচিত হলেন
নাভিদ মাহবুব। সেবার নাভিদকে সেরা হিসেবে বেছে নেওয়ার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন
বিচারক যে তার কৌতুক ছিল অশ্লীলতামুক্ত, হাস্যরসাত্মক এবং বুদ্ধিদীপ্ত।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তার কৌতুকে ছিল দারুণ সব চিন্তার খোরাক।
এরপর
কমেডির নেশা যেন পেয়ে বসে তাকে। স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হিসেবে বিভিন্ন
জায়গায় শো করতে করতে একসময় মাথায় আসে, দেশে ফিরে একটা কমেডি ক্লাব করবেন
যেখানে লোকজন আসবে এবং কৌতুক শুনবে। ২০১০ সালের মাঝামাঝি বারিধারায় ছোট্ট
পরিসরে (আমার বাসার কাছকাছি )
খুলে বসলেন 'নাভিদস কমেডি ক্লাব'। এখন অবশ্য সেটা ঠিকানা বদলে গুলশানের
আরএম সেন্টারে। যুক্তরাষ্ট্রের ডাকসাইটে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান ববি কলিনস,
এডি ব্রিল, ইয়ান ব্যাগ, আজহার ওসমানও এসেছিলেন নাভিদের আমন্ত্রণে। কিন্তু
কমেডিয়ান তো শুধু হাসায় তার আবার কি এত মূল্য? এই হাসির মাঝেও আছে গভীর
ইঙ্গিত আর কমেডির মধ্য দিয়ে মানুষকে একটা মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেন নাভিদ।
স্ট্যান্ড আপ কমেডির একটা বিশেষত্ব-মানুষের সামনে অনর্গল কথা বলে যেতে হয়।
যাতে লোক হাসে। কিন্তু কাজটা বেশ কঠিন। আর তাই এই প্রেজেন্টেশনে সফল
হওয়াটাও অনেক বড় ব্যাপার আর নাভিদ মাহবুব তেমনি একজন সফল মানুষ।
ইঞ্জিনিয়ার থেকে কমেডিয়ান
সবদেশে-সবকালে
প্রায় সবখানেই বক্তৃতার গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবী বদলে দেয়া
সিদ্ধান্তগুলোর ঘোষণা হয়েছে কোন না কোনো বক্তৃতার মাধ্যমে। কয়েক মিনিটের
বক্তৃতা বদলে দিয়েছে কোন দেশের মানচিত্র; কোন জাতির ভাগ্যাকাশ। সেসব
বক্তৃতাতে এক ধরনের যাদুশক্তি ছিলো। কয়েক মিনিটে আবৃত্তি করা সেসব
পঙক্তিমালার শক্তি – লক্ষ, বুলেট বোমাকে হার মানিয়েছে। যুগেযুগে আদর্শ
প্রচারের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মাধ্যম বক্তৃতা।
সেরা বক্তৃতাগুলি
আমি এক স্বপ্ন দেখি :: মার্টিন লুথার কিং এর ঐতিহাসিক ভাষণ
বঙ্গবন্ধু
মাওলানা ভাসানী
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ- একজন আলোকিত মানুষ ও সুযোগ্য বক্তা
“ভালোবাসার কাজটি খুঁজে নিতে হবে” – স্টিভ জবস এর বিখ্যাত সমাবর্তন বক্তৃতা
আগেই বলেছি-
উপস্থাপনা
এবং বক্তৃতা এমন একটা মাধ্যম যা আমাদেরকে অন্যদের সামনে আমাদের যোগ্যতা ও
সৃষ্টিশীলতার পরিচয় প্রকাশ করে। কেউ যদি হতে চায় শিক্ষক, কর্মক্ষেত্রের
অফিসার এবং নেতৃস্থানীয় কোন ব্যক্তিত্ব তবে এই স্পীচ ও উপস্থাপনার কলা কৌশল
শেখা খুব জরুরী। কেঊ কেউ ভাবে আমার দ্বারা এটি হবে না মানে একেবারেই
অসম্ভব কিন্তু এটা ভুল। শুধু একটু সতর্ক প্রস্তুতি ও কিছু কলা কৌশল অবলম্বন
করলে যে-কেউ একজন সফল ও জনপ্রিয় উপস্থাপক হতে পারে।
কাজেই
বক্তৃতা, স্পীচ বা প্রেজেন্টেশন? আর নয় ভয়, আর নয় ভীতি!!!!!! সব দ্বিধা,
দ্বন্দ ভয়, লজ্জা কাটিয়ে হয়ে উঠি সফল বক্তা, মনের ভাবটি বা বার্তাটি
সফলভাবে প্রকাশ করে পৌছে যাই অন্যের কাছে, খুব সহজেই।
Sunday, June 12, 2016
সপ্রতিভ বক্তব্য, লেকচার, উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশনের ছলাকলা বা কলাকৌশল |
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Write comments