নবী সোলেমান তার পবিত্র ইবাদতখানা গড়া
শুরু করেছিলেন সর্বশক্তি দিয়ে। যারা ইতিহাসের হাঁড়িতে দু-চার লোকমা খানা খেয়েছেন, তারা জানেন : এই সর্বশক্তি মানে মানুষ, জিন, অদৃশ্য শক্তি, পশু-পাখি-পতঙ্গ এবং মাছ পর্যন্ত। কাকে
কী কাজে লাগানো হয়েছিল, তার হদিস বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এটি ঠিকই বোঝা যায় যে, নির্মাণটি হয়েছিল বিশ্বসেরা। পৃথিবীর মধ্যাঞ্চল তো বটেই, দূর-দূরান্তের পর্যটকরাও তার প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। এমনকি আমাদের হিন্দুস্তানের অতি প্রাচীন গাথায়ও সেই উপাসনালয়ের বর্ণনা
আছে!
ইহুদিদের মধ্যে যারা বর্বরবাদী নন তারা সেই ইবাদতগৃহকে এমনকি ‘মন্দির’ বলতেও নারাজ। রাতে আমি এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করেছি। কি নাম দেয়া যায় এই ডোম-অব-রককে? পাহাড়, গম্বুজ, নাকি উপাসনালয়? খ্রিষ্টানদের কিছু উদাসীনতাও আমাকে ব্যথিত করেছে; কারণ তারা রোম-মস্কোর পাপাল-দ্বন্দ্ব নিয়ে এত ব্যস্ত যে, জেরুসালেমকে আমলেই নেয় না। অথচ ভাবলে অবাক লাগে রোমের সাথে খ্রিষ্টধর্মের যোগাযোগ প্রায় শূন্য। ড্যান ব্রাউন যে অবাস্তবতাকে প্রায় অসার প্রমাণ করে দিয়েছেন তার ফ্যান্টাসি-ট্রিলজি অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমন্স; দ্য দ্য-ভিঞ্চি কোড এবং দ্য লস্ট সিম্বল লিখে। সন্দেহবাদ, সিম্বলিজম, স্পাই-মেনিয়া মিশেলের তুমুল হঠকারী-জগাখিচুরিকে তিনি উত্তম পরিবেশনায় গেলাতে পেরেছেন; যদিও শেষ পর্যন্ত যার সব কিছুকেই ভাঁওতা মনে হয়। অথচ কনস্টান্টিনোপল্স-এ ঘটানো মিথ্যাকে সামান্য পুনর্বিবেচনা করে যদি বৈজ্ঞানিক সত্যটুকুও গ্রহণ করার সদিচ্ছা হতো আমার দৃঢ় বিশ্বাস যিশুর মানবিক-সংশ্লিষ্টতা এক দিকে যেমন ঐতিহাসিক বিশ্বাসযোগ্যতা পেত; অন্য দিকে উজ্জ্বল হয়ে উঠত জেরুসালেম!
ঝলসে যাওয়া চোখ
ধাতস্ত হওয়ার পর আমি এসে দাঁড়ালাম কুব্বাত-ই-সাখরার মূল গেটে। এই সাখরা বা ডোম-অব-রক আসলেই অনেক বড়। এর যে কত নাম-উপনাম, আল্লাহই ভালো জানেন। মসজিদ নামে পরিচিত না হলেও মুসলমানরা একে সুলেমান-মসজিদেরই
মর্যাদা দেয়। খ্রিষ্টানরাও একে মান্য করে যিশু-মেরীর স্মৃতিবিজড়িত বলে এবং ইহুদিরা তো একে আদি ও
একমাত্র কেবলা বলেই সম্মান করে; উপরন্তু তক্কে তক্কে থাকে, এখানেই তৃতীয়-টেম্পল বানানো যায় কি না!
তো সে যা-ই হোক, আমি হাঁটছি আর দেখছি নবী সোলেমানের স্থাপনা। ডোম-অব-রকের মূল ইমারতের দরোজা চারটি। তবে প্রধান দরোজা উত্তর-পশ্চিমে। এর বাইরের যে দেয়াল, তা প্রতি পাশে ৬৭ ফুট লম্বা এবং ৩৬ ফুট চওড়া। সিলিংয়ের নিচে প্রতিটি দেয়াল দু’ভাগে বিভক্ত। নিচের অংশে ৭টি করে গবাক্ষ এবং প্রাচীন পাথরের ফ্যাকাসে-সাদা দেয়ালের গায়ে আঁকা ধূসর-কালো চিকন-নকশায় সজ্জিত। ওপরের অংশ উজ্জ্বল-নীল ইজনিক-টাইল্স আবৃত। নানা নীলের নকশাকৃত মোজাইকের মধ্যেই জানালা ও দরোজার ভাব প্রকাশিত। ওপরের অলিন্দগুলোকে পার্থক্য করা হয়েছে কমলা-হলুদ এবং সাদা টাইলসের বর্ডার দিয়ে।
জানালাগুলোর ওপরেই টানা সিলিং পুরো পাশ জুড়ে। সিলিংয়ের ওপরের অংশেও নীল টাইলসের নকশায় ফুল এবং আলপনা। এবং তিন সারি ক্যালিগ্রাফিতে অসাধারণ কৌশলে কুরআনের সেই বাণী খচিত যার মর্মার্থ এরকম : ‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি তার বান্দাকে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে দূরতম মসজিদ (আকসা) পর্যন্ত যার চার পাশকে আমি সুশোভিত করেছি যাতে আমার নিদর্শনাবলি তাকে দেখাতে পারি। আমিই সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা’ (১৭:১)।
কী করে এই অষ্টভুজ সুলতান আবদুল মালেক তৈরি করিয়েছিলেন এবং কেন তার জবাব কেউ কোনোদিন দেয়নি। যখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো মসজিদই দুনিয়ায় বানানো হয়নি, এমনকি কাবাও ছিল সাদামাটা। সে যুগে এই অভূতপূর্ব নির্মাণে প্রশ্ন জাগে বৈকি! তবে কি তিনি খ্রিষ্টানদের দম্ভকে চাপা দিতে চেয়েছিলেন অলৌকিক এই নির্মাণের তলায়? কিন্তু তাই বা কি করে হয়? ইসলাম যে নিরহঙ্কার সংস্কৃতির উদ্ভাস ঘটিয়েছে তার সাথে এ যে একেবারেই যায় না। লেখাগুলো এত বড় ও এত ব্যাপক যে, লম্বায় তা ৭৩৪ ফুট আর চওড়ায় প্রতি অক্ষর তিন মানুষ সমান। আনমনে আমি পা বাড়ালাম সেদিকে। কি আছে ডোম অব রকের ছাদের নিচে?
খুবই সাদামাটা এর অভ্যন্তর। যে পাহাড়টার চূড়ার জন্য এর ওই নাম সেটিও খুব বড় নয়। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো। ইহুদিরা বলে, এখানেই ইসহাককে কোরবানি দেয়ার পরীক্ষা দিয়েছিলেন নবীকুলশিরোমনি হজরত ইব্্রাহিম। আমরা জানি, সেটা ঘটেছিল মক্কায় এবং সেই পরীক্ষার পাত্র ছিলেন ইসমাইল। দ্বন্দ্ব এই মিথ নিয়েই। তো সে যা-ই হোক, পাহাড়টি আরো তিনটি কারণে অতিমাত্রায় পবিত্র। প্রথমত, এখানেই বাদশাহ সোলেমান তার ধর্ম-মন্দির স্থাপন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, এখানেই সংরক্ষিত ছিল আর্ক অব কোভেন্যান্ট এবং তৃতীয়ত, এখান থেকেই নবী মুহাম্মদ তাঁর মেরাজ শুরু করেছিলেন।
চার দিকে বুক
সমান রেলিংঘেরা জায়গাটি খুবই সাদামাটা। সব পাথুরে পাহাড়ের মতো কালচে ধূসর রঙের পাহাড় চূড়া। ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। তবে
কঠোরতাও খুব বেশি নেই। চার দিকে তাকাতে তাকাতেই চোখ গেল সুউচ্চ গম্বুজের দিকে। আশ্চর্য সুন্দর ক্যালিগ্রাফি, আলপনা এবং লাল-সবুজের সমারোহ যেন আমার দেশের পতাকা। মনের আকাশে অজান্তে ভেসে এলো শিল্পী কামরুল হাসানের স্মৃতি। এই
মানুষগুলো বর্ণিল করে গেছেন আমাদের অস্তিত্ব ও চেতনা। রঙে, স্বপ্নে, উদ্ভবে ও স্বাধীনতায়। যার খুব কম অংশই আমরা উপলব্ধি করি! শেরেবাংলা নগরে
বসেও যেমন আমি মনে করি না এ কে ফজলুল হককে। এ-ও যেন তেমনি প্রহসন!
দুটো বিন্যাসের
ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশাল গম্বুজ। বাইরের সারিতে আটটি মোটা স্তম্ভ। যার ফাঁকে আবার দু’টি করে সরু খুঁটির ২৪টির উলম্বন। বাইরের এই স্তর ডোমের ডিজাইনের সাথে সমতুল্য। আট কোণা। কিন্তু ভেতরের স্তরটি পূর্ণ
বৃত্তাকার। মোটা স্তম্ভ চারটি। আর ভেতরে ভেতরে সরু সরু খুঁটি তিনটি করে। প্রতিটি মোটা স্তম্ভ পাথরের এবং বাইরে দিকে টাইলস আবৃত্ত তেরোশ’ বছর ধরে পৃথিবীর সবগুলো প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক ঝাঁকুনি থেকে যা এই রহস্যাবৃত ডোমকে বাঁচিয়ে
রেখেছে।
দুই সারি খুঁটির মাঝের অংশে উজ্জ্বল লাল কার্পেট। কোথাও কোনো মোমবাতি নেই, হাদিয়া সংগ্রহের ‘মোতাওয়াল্লি’ নেই; নেই কোনো আড়াল। তবে আমাকে আশ্চর্য করে দিলো সুলতান সালাদিন আইউবির ক্যালিগ্রাফ আর দেয়ালের আয়াতগুলো। প্রায় নিরহঙ্কার সেই উচ্চারণে যে কথা খুব সাদামাটাভাবে বলা হয়েছে তা হলো আল্লাহর সাথে মানুষের শারীরিক সম্পর্কের অবাস্তব সম্ভাবনাকে অস্বীকার। এই সরল বিষয়টি আমাকে তীব্রভাবে নাড়া দিলো এবং আমি শিউরে উঠে ভাবলাম ড্যান ব্রাউনের ‘উদ্ভট’ থিওরি তো নাসিরুদ্দীন হোজ্জার সেই কড়াইয়ের গল্পের মতো, যা বাচ্চা দিলে তার মালিক বিশ্বাস করলেও মৃত্যুকে বিশ্বাস করে না। যিশু যদি ঈশ্বরের পুত্রই হতে পারেন, তো তার স্ত্রী-পুত্র থাকা তো অস্বাভাবিক হবে কেন, যা বয়ে নিয়ে চলছে হলি গ্রেইলকে? আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, অথচ ট্রিনিটি-থিওরিতে বিশ্বাসী খ্রিষ্টানরা আসলেই বিপাকে পড়েছে, কড়াইয়ের মৃত্যু তাদের মেনে নিতেই হবে।
ডোম অব রকের বাইরের মতো, ভেতরটাও অষ্টভুজ। এই জ্যামিতিক বিন্যাসের বহু কারণ তাত্ত্বিকেরা খোঁজার চেষ্টা করেছেন, যে দিকে চোখ ফেরালে মাথা গুলিয়ে যায়। তবে এই টেম্পল মাউন্টের সর্বত্রই চতুর্ভুজ ও অষ্টভুজের নানা ব্যবহার চোখে পড়ে। এমনকি পুরনো জেরুসালেমে দেয়ালেরও আটটি গেট। টেম্পল মাউন্টের সিঁড়ি আটটি, কানাতির আটটা, ডোমের বাহু আটটি, খুঁটি আটটি এবং নামও আটটি।
আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এখানে কি কখনো নামাজ হতো? এটাই কি আমাদের আদি কিবলা? বায়তুল মাকদাসের ‘কিবলা’ কি একটি শহর, পাহাড়, নাকি এই ডোম? মসজিদুল আকসা নামে যে একতলা মসজিদটি এই পাহাড়েররই দক্ষিণ কোণে অবস্থিত যেটি নির্মিত হয়েছে খলিফা ওমরের নির্দেশে ও নির্দেশনায় সেটি আর ‘এটির’ এই দ্বিঅবস্থান কেন? কেন তার সেই বিখ্যাত নামাজের ঘটনা ওমর ঘটিয়েছিলেন দুটো কেন্দ্র থেকেই আধা মাইল পশ্চিমে গলগাথায়? আর কেনই বা মসজিদ না হওয়া সত্ত্বেও এই ডোম অব রককেই গড়া হলো এমন আশ্চর্য সৌন্দর্যে?
ডোমের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যও যে এত নয়নাভিরাম হবে আমি ভাবিনি। উজ্জ্বল লাল কার্পেট বিছানো, গোলাকার চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে আমি যেন টের পাই বোরাকের অস্তিত্ব। কেমন অদ্ভুত সেই বাহন! ঘোড়ার মতো আবার পাখাযুক্ত পঙ্খীরাজ! সমরখন্দ-বোখারা ভ্রমণে আমি আমির তৈমুরের এক অবিশ্বাস্য গল্প শুনেছিলাম। তৈমুর শুধু মহান বীর ছিলেন তাই নয়, ছিলেন অসম্ভব বিজ্ঞানমনস্কও। পারসিক সা¤্রাজ্যের প্রায় সব প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের তিনি উচ্চ পারিতোষিকে বশ করে নিয়োজিত করেছিলেন তার স্বপ্নের সমরখন্দ গড়ার কাজে। সমরখন্দের যে অসাধারণ মিনার এবং উলুবেগ-মাদরাসার নির্মাণ কৌশল এত দিন পরও আমাদেরকে বিমোহিত করে দেয় সেই নির্মাণের প্রধান স্থপতি ছিলেন একাধারে প্রকৌশলী, রসায়নবিদ এবং কবি। মাদরাসা নির্মাণের শেষ পর্যায়ে তৈমুর অভিযানে বেরোন সাসানিক সম্রাটের বিরুদ্ধে। প্রায় আট মাস লেগে যায় পূর্ব তুরস্ককে বশে আনতে। ইত্যবসরে তৈমুরের কনিষ্ঠ স্ত্রী পরমাসুন্দরী বিবি খানুম প্রেমে পড়ে যান প্রকৌশলীর। রূপে যিনি রাজহংস, গুণেও যে তিনি অশ্বরাজ হবেন সে তো বলাই বাহুল্য। ফল কি দাঁড়াল? তাদের প্রণয় শুরু হলো রাধাকৃষ্ণকে হার মানিয়ে। বোখারা সুন্দরীর অনিন্দ্যসুন্দর মুখ দেখে প্রকৌশলী নিত্যনতুন ‘বিস্ময়’ উপহার দিতে শুরু করলেন। আজ বাদাখশানী-চুনির আংটি, তো কাল দুরবীনে আকাশ-দর্শন। সন্ধ্যার মাধুরীতে প্রেম হলো তো শুকতারার লালীই বা বাদ যাবে কেন? এভাবেই সেই প্রণয় ফিসফিস থেকে ছড়িয়ে গেল আমিরের কর্ণকুহর পর্যন্ত। নিজের সিংহাসনে সুস্থির হতে না হতেই প্রধান উজির ভয়ে কম্পিত হয়ে তুললেন কথাটা। আমির তিমুর সিংহের গর্জনে উঠে দাঁড়ালেন : কোথায় সে পামর?
মাদরাসার বিশাল গম্বুজ কেমন হয়েছে দেখতে তখন পাশের সুউচ্চ মিনারে বসেছিলেন প্রকৌশলী। উদ্যত তরবারি হাতে মহা প্রতাপশালী আমির তিমুরকে ছুটে আসতে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলেন তিনি। পেছনের মাচায় ছিল তার ছোট্ট প্রকৌশল-ল্যাবরেটরি। দ্রুত সেখানে থেকে এক ঘোড়াকৃতির বাহন টেনে বের করলেন তিনি।
আমির তিমুর হতভম্ব হয়ে গেলেন। প্রকৌশলী কি লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবে?
কিন্তু না। নির্বিকার প্রকৌশলী ক্রুদ্ধ স¤্রাটকে হাসিমুখে টা টা জানিয়ে বললেন, আমি খোরাসানেই ফিরে যাচ্ছি জনাব। দুঃখ খাতুনকে সঙ্গে নিতে পারলাম না। আমার এই কলের-ঘোড়া এখনো পরীক্ষাধীন। দু’জনকে বহন করতে অক্ষম সে। রানীকে আমার তসলিম জানাই।
ক্রুদ্ধ হতভম্ব মোহিত আমির স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখলেন তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক যান্ত্রিক পঙ্খী। তিনি নাকি চিৎকার করে উঠেছিলেন : প্রকৌশলী, তুমি ফিরে এসো। পঙ্খীরাজের বিনিময়ে আমি তোমায় বিবি খানুমকে দিয়ে দেবো। কিন্তু না সে কথা প্রকৌশলীর কানে পৌঁছেছিল; না তিনি ফিরে এসেছিলেন।
মিথ মতে, সোলেমানের ম্যাজিক-কার্পেট আর শ্রীকৃঞ্চের আকাশরথের পর, এটাই পৃথিবীর প্রথম প্লেন!
কদ্দূর যেতে পেরেছিলেন প্রকৌশলী? কারো মতে, উলুবেগের মাদরাসার বাইরে বেরুতেই ইঞ্জিনে গোলমাল দেখা দেয়। আমু-দরিয়ায় তার সলিল সমাধি ঘটে। সেখানে ছোট্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ ‘অজানা গুণীর কবরস্থান’ আজো দৃশ্যমান। অন্য মতে, তিনি চলে যেতে পেরেছিলেন তিমুরের খানাত ছেড়ে এবং আর কোনো সন্ধান তার পাওয়া যায়নি।
আমার মনের আকাশে সেই অচেনা প্রকৌশলীর জন্য শ্রদ্ধার মেঘ ভাসে। জানালায় উঁকি দিয়ে যায় আরব্য রজনী। ভারত-অভিযান থেকে ফেরার আগেই তিমুরের প্রিয়তমা ছোটি বেগম চাইলেন স্বামীকে তুষ্ট করার জন্য এক অমূল্য উপহার দিতে বিবি খানুম মসজিদ। প্রকৌশলীকে সেভাবেই নির্দেশনা দিলেন তিনি। প্রকৌশলী কাজ এগোতে এগোতে প্রেমের নদীতে ডুবলেন। কেউ বলে এটি ছিল একতরফা, কারো মতে, দ্বিপাক্ষিক। সেই প্রেম শেষে অতুলনীয় লিজেন্ডে পৌঁছে যায়। নির্মাণকাজে দেরি করতে থাকেন প্রকৌশলী। তৈমুরের ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছিল, তাই তাড়া দিচ্ছিলেন বিবি তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!! ঠিক আছে তাড়াতাড়িই হবে, তবে শর্ত আছে।
কী শর্ত?
আমাকে চুমু দিতে হবে একটা।
বিবি খানুম ষোলোটা ডিম আনালেন। ডিমগুলোর বাইরের দিকে নানা রঙ করিয়ে প্রকৌশলীকে বললেন : ভাঙো।
প্রকৌশলী ভাঙলেন।
রানী বললেন : বাইরের রঙ যা-ই হোক না কেন, ভেতরে সবই এক। প্রেমও তেমনি।
জবাবে প্রকৌশলী আনালেন দুটো গ্লাস। একটি ভরলেন পানি দিয়ে, অন্যটি স্বচ্ছ শরাবে। বললেন : দুটোই তরল। একটিতে রয়েছে বাতাস, অন্যটিতে বইছে আগুন।
লা-জওয়াব বিবি প্রেমাষ্পদের অকাট্য যুক্তি মেনে গাল এগিয়ে দিলেন।
কিন্তু প্রকৌশলীর স্পর্শ ছিল এতই তীব্র যে, গাল কেটে দাগ বসে গেল। ফিরে এসে তৈমুরের চোখে পড়ে যায় সেই দাগ। পরের কাহিনী তো সবাই জেনেছেন আগে!
প্লেনের মতো উড়াল-যন্ত্র না হলেও ভয়ঙ্কর আবিষ্কারের এমন আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল খোদ আমেরিকাতে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। এক পাগল বৈজ্ঞানিক আশ্চর্য এক মেশিন আবিষ্কার করে বসলেন, যা কোনো জ্বালানি ছাড়াই পঁচিশ দিন পর্যন্ত চলছিল। যথারীতি সমকালীন বিজ্ঞানীরা তার দাবিকে যথেষ্ট অপদস্ত করে এবং অবিশ্বাস তো করেই। শেষ পর্যন্ত তার আবিষ্কারকে যখন পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয় সরকার তদ্দিনে সেই বিজ্ঞানী দুনিয়ার সবার প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন। সিয়াটল শহরের জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা যখন তার পরীক্ষাগারে ঢোকেন, তার আগেই চরম হতাশ ও চুরির ভয়ে ভীত বিজ্ঞানী নিজের হাতে গুঁড়ো করে ফেলেছেন তার যন্ত্র। ক্ষ্যাপা-বিজ্ঞানীরা কাছে পৌঁছার আগেই তিনি উন্মাদ কুঠার হাতে আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে সেই যে নদীতে ঝাঁপ দেন কেউ তাকে আর খুঁজে পায়নি।
কেন জানি না, প্রেম ও অপ্রেমের দুটো ঘটনাই আমার চেতনায় বিম্বিত হয়ে গেল। আমি নিজেকে প্রশ্ন না করে পারলাম না, কেমন ছিল বোরাক?
No comments:
Write comments